ব্লকচেইন

- তথ্য প্রযুক্তি - কম্পিউটার (Computer) | | NCTB BOOK

ব্লকচেইন (Blockchain) হলো একটি বিতরণকৃত, নিরাপদ, এবং অস্বচ্ছল ডেটাবেস প্রযুক্তি যা বিভিন্ন তথ্য বা লেনদেনের রেকর্ড সংরক্ষণ করে এবং এটি একটি চেইনের আকারে সংযুক্ত ব্লকসমূহে বিভক্ত থাকে। ব্লকচেইন প্রযুক্তি মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য ব্যবহৃত হলেও, এর ব্যবহারের ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যেমন স্মার্ট কন্ট্রাক্ট, সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা, ভোটিং সিস্টেম, এবং আরও অনেক কিছু।

ব্লকচেইনের মূল বৈশিষ্ট্য:

১. বিতরণকৃত লেজার (Distributed Ledger):

  • ব্লকচেইন একটি বিতরণকৃত ডেটাবেস, যা একাধিক নোড বা কম্পিউটারে বিতরণ করা থাকে। প্রতিটি নোডে ব্লকচেইনের পূর্ণ কপি থাকে, এবং এটি ডেটা পরিবর্তনের জন্য প্রত্যেক নোডের সম্মতি প্রয়োজন করে।
  • এর মাধ্যমে তথ্য নিরাপদ এবং ট্রান্সপারেন্টভাবে সংরক্ষণ করা যায়।

২. ডেসেন্ট্রালাইজেশন (Decentralization):

  • ব্লকচেইন ডেসেন্ট্রালাইজড, অর্থাৎ এটি কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ বা কেন্দ্রীয় সার্ভার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। এর ফলে ব্লকচেইন ব্যবহারকারীরা সরাসরি লেনদেন করতে পারে এবং মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয় না।

৩. নিরাপত্তা (Security):

  • প্রতিটি ব্লক একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ ফাংশন ব্যবহার করে সুরক্ষিত থাকে। ব্লকের পরিবর্তন করতে হলে তার হ্যাশ মানও পরিবর্তিত করতে হয়, যা অসম্ভব হয়ে ওঠে কারণ প্রতিটি ব্লক পূর্ববর্তী ব্লকের সাথে সংযুক্ত।
  • এটি ব্লকচেইনকে হ্যাকিং এবং জালিয়াতির বিরুদ্ধে নিরাপদ করে তোলে।

৪. ইম্যুটেবল লেজার (Immutable Ledger):

  • ব্লকচেইনের রেকর্ড বা ডেটা পরিবর্তন করা অসম্ভব, কারণ এটি চেইনে যুক্ত হওয়ার পর সকল নোডে বিতরণ করা হয় এবং এটি পরিবর্তন করতে হলে পুরো চেইনের সব নোডকে পরিবর্তন করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব।
  • এর ফলে ব্লকচেইনে তথ্য সংরক্ষণ অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং ট্রান্সপারেন্ট হয়।

ব্লকচেইনের কাজের প্রক্রিয়া:

১. লেনদেন শুরু:

  • একটি ব্লকচেইন লেনদেন শুরু হয় যখন একজন ব্যবহারকারী একটি ট্রানজ্যাকশন (লেনদেন) অনুরোধ করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ ক্রিপ্টোকারেন্সি পাঠাতে চায়, তাহলে লেনদেনের অনুরোধ তৈরি হয়।

২. ব্লক তৈরি:

  • লেনদেনটি একটি নতুন ব্লক হিসেবে তৈরি হয়, যা সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য ধারণ করে, যেমন ট্রানজ্যাকশন ডিটেইলস, সময়, এবং পূর্ববর্তী ব্লকের হ্যাশ।

৩. ভ্যালিডেশন (Validation):

  • ব্লকটি ব্লকচেইনের নেটওয়ার্কে অন্যান্য নোড দ্বারা যাচাই করা হয়। নোডগুলো চেইনে লেনদেনের বৈধতা পরীক্ষা করে এবং যখন সবাই ঐক্যমতে পৌঁছায়, তখন ব্লকটি চেইনে যোগ করা হয়।

৪. ব্লক চেইনে যোগ করা:

  • ব্লকটি ব্লকচেইনে যোগ করা হয় এবং এটি একটি স্থায়ী রেকর্ড হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে পরিবর্তন বা মুছা সম্ভব নয়।

৫. লেনদেন সম্পন্ন:

  • লেনদেনটি সম্পন্ন হওয়ার পর, নেটওয়ার্কে অন্যান্য ব্যবহারকারীরা তা দেখতে পারে, এবং লেনদেনটি চেইনে রেকর্ড হয়ে যায়।

ব্লকচেইনের ব্যবহার ক্ষেত্র:

১. ক্রিপ্টোকারেন্সি (Cryptocurrency):

  • ব্লকচেইনের সবচেয়ে সাধারণ এবং জনপ্রিয় ব্যবহার হলো ক্রিপ্টোকারেন্সি, যেমন Bitcoin, Ethereum, ইত্যাদি। ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল মুদ্রা বিনিময় নিরাপদ এবং স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয়।

২. স্মার্ট কন্ট্রাক্ট (Smart Contract):

  • স্মার্ট কন্ট্রাক্ট হলো স্বয়ংক্রিয় এবং স্বচ্ছ চুক্তি, যা ব্লকচেইনে সংরক্ষিত হয় এবং কিছু শর্ত পূরণ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোন সম্পত্তির লেনদেনের ক্ষেত্রে, শর্ত পূরণ হলে লেনদেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হবে।

৩. সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা (Supply Chain Management):

  • ব্লকচেইন প্রযুক্তি সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় ট্রান্সপারেন্সি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক। এটি প্রতিটি পণ্য বা আইটেমের অবস্থান এবং অবস্থানগত তথ্য সংরক্ষণ করে।

৪. ভোটিং সিস্টেম:

  • ব্লকচেইন ভোটিং সিস্টেমে ব্যবহার করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ এবং নিরাপদ করা যায়। এতে ভোটের ফলাফল পরিবর্তনের সুযোগ কমে এবং জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হয়।

৫. ডিজিটাল আইডেন্টিটি (Digital Identity):

  • ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল আইডেন্টিটি সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব, যা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদ রাখে এবং তা কন্ট্রোল করার ক্ষমতা দেয়।

ব্লকচেইনের সুবিধা এবং সীমাবদ্ধতা:

সুবিধা:

  • নিরাপত্তা: ব্লকচেইন প্রযুক্তি ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে ডেটা সুরক্ষিত করে।
  • স্বচ্ছতা: ব্লকচেইন সিস্টেমে সমস্ত লেনদেন প্রকাশ্য এবং প্রতিটি নোডে কপি থাকে।
  • ডেসেন্ট্রালাইজেশন: এটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা দূর করে এবং ব্যবহারকারীদের নিজেদের মধ্যে লেনদেন করার সুযোগ দেয়।
  • ইম্যুটেবিলিটি: ব্লকচেইনে তথ্য সংরক্ষণ করার পর তা পরিবর্তন বা মুছা যায় না, যা তথ্যের প্রামাণিকতা নিশ্চিত করে।

সীমাবদ্ধতা:

  • স্কেলেবিলিটি সমস্যা: বড় ব্লকচেইনে লেনদেনের সংখ্যা বাড়লে তা প্রক্রিয়া করতে সময় বেশি লাগে।
  • এনার্জি কনজাম্পশন: বিশেষ করে প্রুফ-অফ-ওয়ার্ক (PoW) ভিত্তিক ব্লকচেইন, যেমন Bitcoin, প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ খরচ করে।
  • নিয়ন্ত্রক চ্যালেঞ্জ: ব্লকচেইন প্রযুক্তির বিকেন্দ্রীকরণ এবং গোপনীয়তা অনেক সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

সারসংক্ষেপ:

ব্লকচেইন হলো একটি বিকেন্দ্রীকৃত, নিরাপদ, এবং স্বচ্ছ ডেটাবেস প্রযুক্তি, যা ক্রিপ্টোকারেন্সি, স্মার্ট কন্ট্রাক্ট, সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা, এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে তথ্য সুরক্ষিত, অস্বচ্ছল, এবং নির্ভরযোগ্যভাবে সংরক্ষণ করা যায়, যা আধুনিক প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত।

Content updated By
Promotion